নিজস্ব প্রতিবেদক : টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে সেলিম মিয়া নামের এক পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রভাব খাটিয়ে বসতবাড়ি ভেঙে দিয়ে সংখ্যালঘু পরিবারকে উচ্ছেদের অভিযোগ ওঠেছে। সম্প্রতি উপজেলার মহেড়া ইউনিয়নের নগর ছাওয়ালী গ্রামের সতীশ সরকার ও জয়ন্তি দাস দম্পত্তির বসতঘর ভেঙে দিয়ে তাদেরকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে, মামলা চলাকালিন সময়ে আইনের প্রতি তোয়াক্কা না করে পুলিশ সদস্যদের এমন তা-বে নিরাপত্তাহীনতায় ভূগছেন অসহায় পরিবারটি। প্রকাশ্যে এমন ঘটনা ঘটলেও পুলিশ বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
অভিযুক্ত পুলিশ সদস্য মো. সেলিম মিয়া নারায়ণগঞ্জ পুলিশ লাইন্সে কর্মরত। তবে তিনি বর্তমানে পেশনে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার মহেড়া পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে রয়েছেন। কনস্টেবল সেলিম মিয়ার বাবা শহিদুর রহমান মহেড়া পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে বাবুর্চির কাজ করেন। তারা উপজেলার মহেড়া ইউনিয়নের নগর ছাওয়ালী গ্রামের বাসিন্দা।
জানা গেছে, উপজেলার মহেড়া ইউনিয়নের নগর ছাওয়ালী গ্রামের বাসিন্দা রাধিকা ভূষণ দাসের মৃত্যুর পর তার দুই ছেলে শিশির মুক্ত ভূষণ ও কুমুদ বন্ধু দাস পৈতিক সূত্রে সাড়ে ১৯ শতাংশ জমি ভোগদখল করে বসবাস করে আসছিলেন। দুই ভাইয়ের প্রত্যেকে পৌনে ১০ শতাংশ করে ভোগদখলে ছিলেন। এমতাবস্থায় শিশির মুক্ত ভূষণ ও কুমুদ বন্ধু দাস পরিবার নিয়ে ঢাকায় চলে যান। এরপর থেকে শিশির মুক্ত ভূষণ তার জমিতে চাচাতো বোন জয়ন্তি দাসকে কেয়ারটেকার হিসেবে বসবাসের সুযোগ দেন। পরে জয়ন্তি দাস শিশির মুক্ত ভূষণের ভিটেবাড়িতে একাধিক বসতঘর তৈরি করে পরিবার নিয়ে বসবাস করে আসছিলেন। এক পর্যায়ে সাড়ে ১৯ শতাংশের সাবেক ৮৪ নং দাগের জমিটি বিএস ১৫৫ নং দাগ রূপে রূপান্তরিত হয়ে রেকর্ড প্রস্তুতকারীর ভুলের কারণে বিএস ২১৭ নং খতিয়ানের জমিটি শিশির মুক্ত ভূষণের নামে রেকর্ড না হয়ে তার ভাই কুমুদ বন্ধু দাস ও স্থানীয় মুকুল চন্দ্র দাসের নামে রেকর্ড হয়। রেকর্ড ভুলের বিষয়টি দীর্ঘদিন পর শিশির মুক্ত ভূষণ জানতে পারেন। পরে তিনি আদালতে রেকর্ড সংশোধনের জন্য মামলা করেন। বর্তমানে মামলাটি চলমান রয়েছে।
এদিকে, শহিদুর রহমান ও তার ছেলে পুলিশ সদস্য সেলিম মিয়া কুমুদ বন্ধু দাসের কাছ থেকে ৫ শতাংশ ও মুকুল চন্দ্র দাসের কাছ থেকে ৯ শতাংশ জমি ক্রয় করেন। পরে শহিদুর রহমান ও তার ছেলে সেলিম মিয়া ক্রয়কৃত ওই জমিটি প্রভাব খাটিয়ে দখলে নেওয়ার জন্য চেষ্টা করেন। কিন্তু জমিতে শিশির মুক্ত ভূষণের কেয়ারটেকার জয়ন্তি দাসের বসতঘর থাকায় বেকায়দায় পড়েন তারা। এরপর থেকে পুলিশ সদস্য সেলিম মিয়া জয়ন্তি দাসকে বসতঘর ভেঙে নেওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে হুমকি দিয়ে আসছিলেন। বিষয়টি নিয়ে বেশ কিছুদিন আগে মির্জাপুর থাকায় সালিশি বৈঠকেও বসা হয়। কিন্তু সেখানে কোনো সুরাহা না পেয়ে হতাশায় পড়েন সংখ্যালঘু পরিবারটি।
ভুক্তভোগী জয়ন্তি দাস বলেন, ‘নগর ছাওয়ালী এলাকায় সাড়ে ১৯ শতাংশ জমি শিশির মুক্ত ভূষণ ও তার ভাই কুমুদ বন্ধু দাসের নামে রয়েছে। কিন্তু ভুলক্রমে শিশির মুক্ত ভূষণের নামে রেকর্ড না হয়ে কুমুদ বন্ধু দাস ও স্থানীয় মুকুল চন্দ্র দাসের নামে নতুন রেকর্ডভুক্ত হয়। চাচাতো ভাই শিশির মুক্ত ভূষণের জমিতে বসতঘর তৈরি করে দীর্ঘদিন ধরে আমার স্বামী, মা, বড় বোন ও তার ছেলেকে নিয়ে বসবাস করে আসছি। আমার স্বামী দিনমজুরের কাজ করেন। আমরা গরীব মানুষ। এখন শুনতেছি পুলিশ সদস্য সেলিম মিয়া ও তার বাবা শহিদুর রহমান কুমুদ বন্ধু দাস ও মুকুল চন্দ্র দাসের কাছ থেকে ১৪ শতাংশ জমি ক্রয় করেছে। সম্প্রতি পুলিশ সদস্য সেলিম মিয়া প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্নভাবে বসতঘর ভেঙে দেওয়ার জন্য হুমকি দিয়ে আসছিল। পরে হঠাৎ করে কয়েক মাস আগে আমাকে তারা মির্জাপুর থানায় নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে একটি কাগজে সই দিতে বলেন। কিন্তু আমি দিইনি। সেসময় আমাকে বসতঘর ভেঙে নিতে এক মাসের সময় দেয়। ঘরগুলো সরিয়ে না নেওয়ায় গত ১৮ অক্টোবর পুলিশ সদস্য সেলিম মিয়া ক্যাডারবাহিনী ভাড়া করে এনে আমার থাকার ঘরসহ সবগুলো ঘর মূহুর্তের মধ্যেই ভেঙে দিয়ে রাস্তায় বের করে দেয়। আদালতে মামলা চলমান থাকাকালিন সময়ে সেলিম পুলিশ অন্যায়ভাবে আমাদের উচ্ছেদ করেছে। এরআগে একটি থাকার ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয় তারা। এ পর্যন্ত সেলিম ও তার বাবা শহিদুরের বিরুদ্ধে আমি বাদি হয়ে তিনটি মামলা করেছি। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘সেলিম পুলিশের বাবা শহিদুর রহমানও মহেড়া পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে বাবুর্চির কাজ করেন। আদালতের উচ্ছেদের কোনো নির্দেশনা না থাকা সত্ত্বেও তারা পুলিশের প্রভাব খাটিয়ে আমাদের সাথে এমন অন্যায় কাজ করেছে। আমরা সংখ্যালঘু হওয়ায় তারা এই কাজটি করতে সাহস পেয়েছে। হঠাৎ করে আমাদের বসতঘর ভেঙে দেওয়ায় চরম বিপাকে পড়েছি। কোনো দিশকুল না পেয়ে পরিবার নিয়ে প্রথমে রাস্তার পাশে ঠাঁই নিয়েছিলাম। এখন আমার ভাগনের বন্ধুর বাড়িতে অস্থায়ীভাবে রয়েছি। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে সেলিম পুলিশ ও তার বাবা শহিদুরের বিচার দাবি করছি।’
শিশির মুক্ত ভূষণ বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আমি পরিবার নিয়ে ঢাকায় বসবাস করছি। গ্রামের ওই জমিতে আমাদের এক আত্মীয় জয়ন্তি দাসকে দেখাশোনা করার জন্য থাকতে দিয়েছি। এমতাবস্থায় ওই জমিটি ভুলক্রমে কুমুদ বন্ধু দাস ও মুকুল চন্দ্র দাসের নামে নতুন করে রেকর্ডভুক্ত হয়েছে। বিষয়টি আমি জানতে পেরে আদালতে রেকর্ড সংশোধনের জন্য মামলা দিয়েছে। মামলাটি বর্তমানে চলমান রয়েছে। এ অবস্থায় পুলিশ সদস্য সেলিম মিয়া আমার কেয়ারটেকার জয়ন্তি দাসের বসতঘর ভেঙে দিয়েছে। জয়ন্তি দাস গরীব মানুষ। এভাবে তার বসতঘর ভেঙে দেওয়া ঠিক হয়নি। আমি ঢাকায় থাকি। স্থানীয় প্রশাসনকে বিষয়টি দেখার জন্য অনুরোধ করছি।’
কুমুদ বন্ধু দাস বলেন, ‘সেলিম নামের এক পুলিশ সদস্য ঢাকায় আমার বাসায় এসেছিল। তার কাছে আমি পাঁচ শতাংশ জমি বিক্রি করেছি। সেখানে এখনও আমার জমি রয়েছে। জয়ন্তি দাসকে এভাবে উচ্ছেদ করা ঠিক হয়নি।’
অভিযুক্ত পুলিশ সদস্য মো. সেলিম মিয়া বলেন, ‘কুমুদ বন্ধু দাস ও মুকুল চন্দ্র দাসের কাছ থেকে আমরা ১৪ শতাংশ জমি কিনেছি। জয়ন্তি দাসকে জমিটি ছেড়ে দেওয়ার জন্য একাধিকবার বলেছি। পরে তিনি নিজেই ঘরগুলো ভেঙে নিয়েছে। আমরা তাদের উচ্ছেদ করিনি।’
স্থানীয় ইউপি সদস্য ফজলু মিয়া বলেন, ‘শুনেছি সেলিম ও তার বাবা শহীদুর ১৪ শতাংশ জমি ক্রয় করেছে। জয়ন্তি দাসকে জমিটি ছেড়ে দেওয়ার জন্য বলেছিল। প্রায় ৬-৭ মাস আগে বিষয়টি নিয়ে মির্জাপুর থানায় বসা হয়েছিল। সেখানে জয়ন্তি দাসের ক্ষতিপূরণ হিসেবে এক থেকে দেড় লাখ টাকা দেওয়ার জন্য সেলিম ও শহীদুরকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা টাকাগুলো দেয়নি। পরে কয়েকদিন আগে সেলিম ও শহীদুর জয়ন্তি দাসের বসতবাড়ি ভেঙে দিয়েছে। আদালতের নির্দেশনা ছাড়া এভাবে জয়ন্তি দাসের বসতবাড়ি ভেঙে দেওয়া ঠিক হয়নি।’
মির্জাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোশারফ হোসেন বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে খোঁজ নিচ্ছি। ভুক্তভোগী পরিবার এলে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বাসাইলসংবাদ, ০১ নভেম্বর, ২০২৪ / একেবি
সকলের অবগতির জন্য নিউজটি শেয়ার করুন