
বাসাইলসংবাদ: রবিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮:

এনায়েত করিম বিজয় ॥
শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে বাবা বখতিয়ার রানার দেওয়া এসিড দগ্ধের শিকার মেহিয়া আক্তার বাবলাীর স্বপ্ন ছিল উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সাধারণ মানুষের সেবা করার। কিন্তু সেটি আর হলো না। ১৮ বছরে পা রেখে বুকভরা কষ্ট নিয়ে চিরদিনের জন্য চলে গেলেন না ফেরার দেশে। বাবলী চেয়েছিলেন- সাংবাদিক হয়ে তার মতো নির্যাতনের শিকার অসহায় মানুষদের কথা লিখবেন। আবার ডাক্তার হয়ে দেশের মানুষের সেবা করারও ভাবনা ছিল তার। ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিলো বাবলী। কিন্তু হঠাৎ করেই থমকে দেলো সে। স্বপ্নটা স্বপ্নই রয়ে গেলো। কি অপরাধ ছিল বাবলীর। শুধু মেয়ে হয়ে জন্মটাই কি ছিল বাবলীর অপরাধ? গত ২১ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের মির্জাপুর পৌর শহরের বাইমহাটি এলাকার লোকমান মিয়ার ভাড়া বাড়ির একটি রুম থেকে বাবলীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। কি এমন ঘটেছিলো ওই রাতে (২১ ফেব্রুয়ারি) যে তাকে আত্মহত্যার পথই বেঁচে নিতে হবে। পরিবারের অভিযোগ তাকে হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
তার স্বজনরা জানান, ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বর মাস, তখন মেহিয়া আক্তার বাবলী জন্মগ্রহণ করে ঢাকার সায়েদাবাদ এলাকার একটি পরিবারে। তার বাবার নাম বখতিয়ার রানা ও মা পারুল বেগম। কন্যা সন্তান জন্ম দেয়ায় বাবলীর পরিবারে নেমে আসে অশান্তি। বাবলীর বয়স যখন ৬মাস। তখন বাবলীকে মুখ, কান, পা ও পায়ুপথে পাঁচদিন এসিড ঢেলেছিলেন তার বাবা বখতিয়ার রানা। এ আক্রমণ থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন বাবলী। কিন্তু এসিড হামলায় ওই সময় বাবলীর একটি কান নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়াও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় গলা, জিব্বা ও মুখ। এঘটনায় বাবলীর বাবার বিরুদ্ধে মামলা হলে তিনি গা ঢাকা দেন। এরপর বাবলীর মা তার স্বামীর সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। এরপর ২০১২ সালে বাবলীর মা বিয়ে করেন আবু জাহিদ রাসেল নামের একটি ব্যক্তিকে।
ওই সময় এসিড দগ্ধের ঘটনায় বাবলীর পরিবারকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে বাংলাদেশ অ্যাসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশন। ফাউন্ডেশনটি শিক্ষাবৃত্তির সহায়তায় পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলো বাবলী।
ভর্তি হয়েছিলেন টাঙ্গাইলের মির্জাপুর ভারতেশ্বরী হোমসে। বাবলী থাকতো হোমসের হোস্টেলে।
সেখান থেকে অপমান অপদস্থ করে গত রমজান মাসে বের করে দেওয়া হয় বাবলীকে। এরপর বাহির থেকে লেখাপড়ার সুযোগ দিয়ে হোস্টেল থেকে তার বান্ধবী আছিয়া আক্তার জয়াকে বের করে দেওয়া হয়। একই প্রতিষ্ঠানে ও একই শ্রেণীতে পড়াশোনার কারণে দুইটি পরিবারের সাথে যোগাযোগ ছিল তাদের। আছিয়া আক্তার জয়াকে বিক্রমপুরের লৌহজং এলাকার কলাপাড়া গ্রামের রফিক মিয়া ও ফাতেমা আক্তার সুমি’র মেয়ে।
এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য গত ৩০ জানুয়ারি বাবলীর মা টাঙ্গাইলের মির্জাপুর পৌর শহরের বাইমহাটি এলাকার লোকমান মিয়ার বিল্ডিংয়ের একটি রুম ভাড়া নেন। ভাড়া বেশি হওয়ায় বাবলীর বান্ধবী জয়ার মা ফাতেমা আক্তার সুমি অর্ধেক ভাড়া দেয়ার শর্তে একই রুমে উঠে।
সেখানে জয়া ও তার মায়ের সাথে বাবলী একাই থাকতেন। গত ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে ওই ভাড়া বাড়ি থেকে বাবলীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। বাবলীর আর দুইটি পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফেরার কথা ছিল, ফিরলেন কিন্তু জীবিত নয়, লাশ হয়ে ফিরলেন বাবলী।
এ ঘটনায় মির্জাপুর থানায় বাবলীর মা পারুল বেগম বাদি হয়ে আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগ এনে আছিয়া আক্তার জয়া ও জয়ার মা ফাতেমা আক্তার সুমি এবং বাবলীর কথিত প্রেমিক ঢাকার ওয়ারি থানার হৃদয়কে আসামী করে মামলা দায়ের করেছে।
বাবলীর মা পারুল বেগম বাসাইলসংবাদকে বলেন, ‘জয়া ও জয়ার মায়ের সাথে বাবলী মির্জাপুরের একটি ভাড়া বাড়ি থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছিলো। জয়া ও তার মা বাবলীকে মানসিক নির্যাতন চালায়। নির্যাতনের বিষয়টি আমাকে ফোনে জানিয়েছিলেন। আমার মেয়েকে ওরা মেরে ঝুলিয়ে রেখেছে। আমি ওদের বিচার চাই।’
বাবলীর নানী ময়না বেগম বাসাইলসংবাদকে বলেন, ‘আমার নানু ছিল শান্ত প্রকৃতির একজন মেয়ে। সব সময় হাসিখুশিতে থাকতো। আমার নানু আত্মহত্যা করতে পারে না। ওরা আমার নানুকে হত্যা করেছে। আমি ওদের বিচার চাই।’
তিনি আরো বলেন, গতকাল শনিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) বিকেল ৪টায় বাবলীর আত্মার মাগফিরাত কামনায় দোয়া মাহফিল করা হয়।
মির্জাপুর ভারতেশ্বরী হোমসের অধ্যক্ষ প্রতিভা হালদার বলেন, বাবলী ও জয়ার বিরুদ্ধে হোমস হোস্টেলের নিয়ম শৃঙ্খলাভঙ্গের বিভিন্ন অভিযোগের কারণে প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার সুযোগ রেখে হোস্টেল থেকে বের করে দেয়া হয়।
মির্জাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) একেএম মিজানুল হক বলেন, ঝুলন্ত অবস্থায় বাবলীর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগ এনে বাবলীর মা পারুল বেগম বাদি হয়ে ৩জনের নামে মামলা দায়ের করেছে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত জয়ার মা ফাতেমা আক্তার সুমিকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
বাসাইলসংবাদ/একে