বাসাইলসংবাদ:
সোমবার, ২৬ আগস্ট, ২০১৯:
রেজাউল করিম ॥
বাবা-মা, তোমরা ছিলে বলেই তো আমি আজ দুনিয়ার আলো বাতাস দেখছি। জন্মেও পর তোমরা আমার দুকানে আজানে সুর শুনিয়েছ। জীবনের ঝুঁকি কমাতে আমার নামে পশু কুরবান করে আকিকা দিয়েছিলে। সুন্দর একটি নাম তোমরাই তো রেখেছিলে।
যেদিন আমি দুনিয়াতে প্রথম আসি সেদিন তো বড়ই অসহায় ছিলাম আমি। নিজেকে নাড়াতে পারিনি সেদিন। কান্না ছাড়া কোন শব্দ ছিলো না আমার মুখে। চিৎকার করে কেঁদেছিলাম বলে ওরা সবাই দুরে চলে যেতো। সেদিন তুমিই ছিলে একমাত্র আমার পাশে। কান্না যেদিন অন্যের বিরক্তের কারণ ছিল সেদিন আমাকে বোঝার জন্য তোমার কাছে কান্নাটা একমাত্র ভাষা ছিলো।
প্রথম কান্নার ভাষাটা একমাত্র তুমি বুঝতে মা। কান্নার কোন সুর ক্ষুধা পাওয়া, কোন সুর কষ্ট পাওয়ার আবার কোন সুর কোলে তোলার। কতো রাত কেটেছে দু-চোখের পাতা এক করতে পারনি মা। ঘুমের ঘরে যখন ভিজিয়েছি বিছানা। ভেজা বিছানায় মা শুয়েছ আমাকে দিয়েছ শুকনো বিছানা। বারবার ভেজানোতে পুরনো কাঁথা সব করেছে জরো মা। তবুও খান্ত হইনি অবুঝ আমি। অবশেষে তোমার আচলের ওপর ঘুমিয়েছি শিশু আমি। একই অভিযোগে কতো রাত শুয়েছি তোমার বুকের ওপর। তোমার নরম বুকটাকে আমার জন্য বানিয়ে দিয়েছ বিছনা।
খাইনি এই অভিযোগে কতো গালমন্দ দিয়েছ মা। অথচ আমি খেয়েছিলাম সেদিন ঠিকই। তবুও তুমি ভেবেছিলে তোমার খোকা হয়তো কাঁদছে ক্ষুধার জ্বালায়? তোমার গন্ধ কি তুমি জান না মা। তুমি কি এটুকু বোঝনি তোমার ছোঁয়ায় সেদিন বন্ধ হয়েছিল তীব্র কান্না।
কতো রাত জেগেছ মা আমার ছোট-খাট বালাইয়ে। একটু জ¦রে ঔষধ জোটেনি মাগো। গভীর রাতে শুধু তুমি আমি জেগে। আমি জেগেছিলাম মাগো তীব্র জ¦রে। তুমি জেগেছিলে মাগো আমার মাথায় জলপট্টি দিতে। বারবার জিগাতাম তোমায় মাগো রাত পোহাবে কবে? তুমি মা মাথায় হাত এমনভাবে ভুলিয়ে দিয়ে মিথ্যে সান্ত¡না দেওয়ার আগেই দুচোখ আটকে যেতো ঘুমের ঘরে। আজও মনে পরে মা সেদিন তুমি ছাড়া আমি ছিলাম বড়ই অসহায়।
বন্ধুদের সাথে কতো রাত কেটেছে বারির বাইরে। গভীর রাতে যখন চুপ করে দুয়ারে রেখেছি পা। কেমনে তুমি বলতে খোকা এতো রাত কেনরে বাবা ? নানা অজুহাত দেখিয়ে যখন মিথ্যে বলতাম তুমি কেমনে বলতে মা এতো রাতে কেন চরই ভাতি বাবা ? সেদিন বুঝিনি মা। আজ বুঝি তোমার-আমার নাড়ের স্পন্দন বলে দিতো তোমাকে আমার সব কথা।
কতো দিন কতো রাত তোমার পেটে যায়নি কোন অন্নরে মা। আমাকে তুমি বুঝতে দাওনি তুমি যে কিছুই খাওনি। কতোবার বলেছি মা চল একসাথে খেতে বসি। আমার খাবারের বাটি সাজিয়ে নরম স্বরে বলতে তুমি খোকা কাজটা সেরে আসি। সেদিন বুঝিনি মা, আজতো বুঝি। আমার কথা ভেবে সেদিন তুমি খেতে বসনি একসাথে।
একটু ভালো পোশাক, একটু ভালো খাবারের জন্য বাবাকে না কতো চাপ দিয়েছ মা। বাবা কি চেষ্টা কম করেছে মা ? বৃহস্পতিবার পাটের বোঝা বাবা মাথায় নিয়ে একহাত ধরে বাবা পিছু পিছু হাঁটিয়ে নিয়ে যেত হাটে বাবা আমায়। বলতো বাবা কি খাবি খা। গরম জিলাপি যখন হাতে দিতো বাবা , ভাবতাম দুনিয়ার সমস্থ সুখ এই হলো পাওয়া।
ফলের ঝাঁকা মাথায় নিয়ে যখন বাবা ছুটতো হাটের দিকে। আমি চলতাম পিছে পিছে। বাবা বাজারে বিক্রি করতের বাড়ির নানা রকম ফল। আমাকে কিনে দিত বাবা খুরমা-দানাদার আর ঝালমুড়ি। বাপ-বেটা আবার ফিরে আসতাম হেঁটে হেঁেট। হেঁটে আসাটা কষ্ট লাগেনি সেদিন । একসাথে হাঁটার মাঝেই খুঁজে পেতাম পিতৃস্নেহ আর ভালোবাসা।
বড় মাছ না কিনতে পারায় বাবা বারবার বলতেন খোঁকা যতো মাথা খাবে মাথায় ততো বুদ্ধি হবে। গলায়র কাটা ফুটে যাবে তারপর মাথায় বুদ্ধি বাড়তে ছোট মাছ খেতাম অনেক মজা করে। এখন বুঝি বাবার হাতটা যখন খাটো থাকতো তখনই থলেতে ছোট মাছ তুলতো। তখন বুঝিনি বাবার তোমার খোকার মুখে হাসি ফোঁটাতে কতো কিছু না করছে।
বাজার থেকে যখন হাফপ্যান্ট কিনে দিয়েছ আমায়। তখন প্রতিবারেই বলতে বাবা, হাট থেকে ফিরতে এতো দেরি হলো জানস কেন বাবা? আমি বলতাম নাতো বাবা। বাবা চাপাস্বরে বলতেন এই ভালো প্যান্টটা যেন হাতছাড়া না হয় সেজন্যই এতো দেরি করে প্যান্টটা সাথে নিয়ে এসেছি বাবা। সেদিনের সেই হাফপ্যান্টে যে আনন্দ ছিলো আজ কোর্ট-প্যান্টেও তা পাইনারে বাবা।
কতো চাওয়ার পর দিতে নতুন জুতো কিনে। পারিনি তা বেশিদিন ধরে রাখতে। খেলতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে হয়তো যেত জুতোর ফিতেটাই ছিঁড়ে। বাবা-মা একসাথে বলতে তোকে দিতে হকে লোহার জুতো কিনে। পরদিন সেই বাবাই বাজার থেকে সেড়ে দিতো আবার সেই জুতো। লোহার নয় তাই ফের ছিড়ে যেতে দুপায়ের জুতো। আসলে লোহার জুতো ছিলনা। ছিলনা সেটা বকুনি। ছিলো সেটা বা-মায়ের আদও আর আর্থিক অপরাগতা।
তোমরা দিয়েছ তোমাদের খোকাকে অনেক কিছু। আমি কি পেরেছি দিতে তোমাদেরকে সামান্য কিছু। তোমরা যা কিছু দিয়েছ তার সবকিছুতে ছিলো আদর-ভালোবাসা। আমি যা করছি তাতে কি পাও সেইরকম একটু ভালোবাসা? তোমাদের ঋণ শোধানোর মতো নয়। তবুও বলি, তোমাদের বৃদ্ধবয়সে একটু চেষ্টা করতে আমার তো লোকসান নয়। দানের বদলে প্রতিদান হয়। ভালোবাসা বদলে নেই কিছু। দ্বায়িতের বদলে কি দিয়ে শোধাবো ঋণ ? এ ঋণতো শোধাবার নয়। বিধাতা যাদের জন্যে এসেছি এই ভুবনে তাদের নেক হায়াত বাড়িয়ে দাও। যেন তাদের সেবাটুকু দিতে পারি জীবনে। আমি ছিলাম অবুঝ সেদিন ওরা ছিল পাশে। বয়সের ভারে তারা আজ আমার সেই জায়গাতে। অবুঝ বাবা-মায়ের পাশে রেখো আমার মতো সবাইকে। যাদের ভাগ্যে জোটেনি পিতৃমাতৃস্নেহ। ওপারে মিলাইয়া দিও ওদের মা-বাবা আর সনতানকে। স্নেহের প্রতিদানে কর্তব্য পালনের আগে যাদের বাবা-মাকে তুলে নিয়েছ ওপারে তাদেরকে রেখ তুমি জান্নাতের বাগানে।
লেখক : সংবাদকর্মী ও শিক্ষক
বাসাইলসংবাদ/একেবি